* সূচক বাড়ছে লেনদেনের গতি * বাজেট ও মুদ্রানীতির ইতিবাচক প্রভাব * বিনিয়োগকারীদের চোখে স্বস্তি * আইসিবিকে বড় সহায়তা * দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা * চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পথ উন্মুক্ত
দীর্ঘ মন্দা আর অনিশ্চয়তার পর দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবারও আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। টানা কয়েক মাস ধুঁকতে থাকা বাজারে হঠাৎ সূচকের উল্লম্ফন ও লেনদেনের মাত্রা বাড়ায় অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উদ্যোগ, স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং বিনিয়োগবান্ধব সিদ্ধান্তের কারণে বিনিয়োগকারীদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ‘ডিএসইএক্স’ টানা সাত কার্যদিবস বেড়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৯২ পয়েন্টে- যা গত আট মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু সূচক নয়, লেনদেনেও ফিরছে গতি। গত বুধবার ডিএসইতে ৯৮৬ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়- যা গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বৃহস্পতিবারও লেনদেন হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছায়।
এই ধারাবাহিকতা দেখে বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক মাস আগেও যেখানে লেনদেন গড়ে ৫০০-৬০০ কোটি টাকার নিচে ছিল, সেখানে এখন তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে আবারও বাজারমুখী হচ্ছেন, যা বাজারের স্থিতিশীলতার লক্ষণ।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বাজারে গতি ফেরাতে নেওয়া হয়েছে বেশকিছু সাহসী উদ্যোগ। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ৫ দফা নির্দেশনায় বাজার সংস্কারের আশ্বাস বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থা তৈরি করেছে। এই নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে-বহুজাতিক কোম্পানির সরকারি শেয়ার বাজারে ছাড়া, ভালো দেশীয় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহ দেওয়া, বিদেশি বিশেষজ্ঞ দিয়ে বাজার সংস্কার, অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং বড় কোম্পানিগুলোকে ঋণের বদলে শেয়ার বা বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহে উৎসাহিত করা। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও পুঁজিবাজারবান্ধব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করের ব্যবধান বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করায় ভালো কোম্পানিগুলো বাজারে আসতে আগ্রহী হচ্ছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কিছুটা শক্তিশালী হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারকে বিকল্প বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে ভাবছেন।
সরকার পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-কে ১০ হাজার কোটি টাকার স্বল্পসুদী ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি ১০ হাজার কোটি টাকার ‘ক্যাপিটাল মার্কেট সাপোর্ট ফান্ড’ গঠনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই দুটি পদক্ষেপ পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা রাখবে। ব্রোকারেজ হাউজগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে ফিরে আসা আস্থা এখন অনেক স্পষ্ট। আগে যারা আশাহত হয়ে বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তারাও এখন আবার বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। বিশেষ করে মৌলভিত্তি ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনতে আগ্রহ বাড়ছে। একজন খুচরা বিনিয়োগকারী বলেন, অনেকদিন পরে মনে হচ্ছে— সরকার আসলেই পুঁজিবাজার নিয়ে ভাবছে। আগের মতো আর অন্ধকারে নেই। এখন সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন হলে বাজার আরও ভালো হবে।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই আস্থার ধারা ধরে রাখতে হলে শুধু স্বল্পমেয়াদি সিদ্ধান্ত যথেষ্ট নয়। দরকার হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানো, বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং সব ধরনের কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। আর সেটি তখনই সম্ভব, যদি সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাজার অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয় থাকে। বাজারে পুরোপুরি আস্থা ফিরতে আরও সময় লাগবে। এখনও অনেক শেয়ারের দাম অনেক নিচে, দরপতনের ভয় কিছুটা রয়ে গেছে। তবে বর্তমানে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা ধরে রাখা গেলে খুব দ্রুতই বাজারে স্থায়ী গতি ফিরবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সরকারের নীতিগত সহায়তা অব্যাহত থাকে, কর কাঠামো আরও সহজ হয় এবং বাজারের স্বচ্ছতা বাড়ে, তবে শেয়ারবাজার আগামী এক-দুই বছরের মধ্যেই অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হিসেবে নিজের জায়গা করে নিতে পারবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
